ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটে চীন-তুরস্কের লাভ ক্ষতি কী

ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলোর বিরোধে কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে চীন। অন্যদিকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে মরিয়া এরদোয়ানের তুরস্ক চাইছে ওই অঞ্চলে নিজেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে।

ইউক্রেন সংকট শুরুর পর ধেকেই রাশিয়ার সঙ্গে চিনের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ মিত্র হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও বিপরীত মতের বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এই ইস্যুতে তার ‘উত্তর-প্রতিবেশী’ রাষ্ট্রদের ‘সমর্থনমূলক শব্দের’ চেয়ে বেশি কিছু দেবে না। বড়জোর দেশ দুটির মধ্যে বিদ্যমান কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে পারে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক বেশি জটিল অবস্থানে থাকায় এই ক্ষেত্রে চীনকে নাও পেতে পারে রাশিয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক যত অবনতি হচ্ছে শি জিংপিং ততই পুতিনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন। বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক শুরু হওয়ার পরপরই পুতিন শি জিংপিং এর সঙ্গে দেখা এবং বৈঠক করেছেন। দুই দেশের নেতৃদ্বয় পরষ্পরকে আরো গভীর সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। রাশিয়ার তেলদানব হিসেবে খ্যাত রোসনেফ্ট বলেছেন, তারা আগামী দশকের পরিকল্পনা করে চীনে তেল সরবরাহ বাড়াতে সম্মতি দিয়েছে।

চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে বৃহস্পতিবার পুতিন বলেছেন, ‘একসঙ্গে কাজ করে আমরা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারি। আজকের ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জগুলির বিরুদ্ধে একসাথে দাঁড়াতে পারি।’

তার এই বক্তব্য চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কেরই ইঙ্গিত প্রদান করছে। তবে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে এই ঝুঁকিগুলো ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু রাশিয়া স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে, তাদের এরকম করার কোনো উদ্দেশ্যই নেই।

লালরেখা অতিক্রম করলে রাশিয়ার ওপর ‘সমস্ত নিষেধাজ্ঞার মা’ চাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন মার্কিন আইন প্রণেতারা। ইউরোপীয় নেতারাও এমন শাস্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন যা ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার সময় রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বাইরে যেতে পারে।

এদিকে চীনের সাথে পশ্চিমাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ আগে থেকেই। সেই সুবাদে চীন তার মিত্রদেরকে কূটনৈতিক সমর্থন প্রকাশ করেছে। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আশংকায় গত শুক্রবার জারি করা এক যৌথ বিবৃতিতে শি জিংপিং এবং পুতিন জানিয়েছেন, তারা উভয়ই ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করেছেন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অফ ডেমোক্রেসিসের সিনিয়র চীনা ফেলো ক্রেইগ সিঙ্গেলটন বলেন, ‘শি জিংপিং প্রায় নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করেন যে রাশিয়াকে সমর্থন করার একটি কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে।’ চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্থায়ী বিবাদে রয়ে গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

দুই দেশের বাণিজ্যে কার কাকে প্রয়োজন?

রাশিয়া বাণিজ্যের জন্য চীনের ওপর গভীরভাবে নির্ভর করে, অন্যভাবে নয়। তবে চীনা অর্থনীতি এরইমধ্যে একটি নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে। তারপরেও কেবল একটি সামরিক সঙ্কটের ঘটনা শি জিংপিংকে তার দেশের ভাগ্য মস্কোর সাথে বেঁধে রাখতে খুব বেশি উৎসাহ দেয় না।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ২০২০ সালের চীনা কাস্টমস ডেটার পরিসংখ্যান বলছে, চীন হলো রাশিয়ার ১ নম্বর বাণিজ্য অংশীদার। রাশিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৬ শতাংশই চীনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু চীনের জন্য ওরাশিয়া অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের বাণিজ্যের মধ্যে চীনের মোট বাণিজ্যের পরিমাণের মাত্র ২ শতাংশ। এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় শেয়ার রয়েছে।

হিনরিখ ফাউন্ডেশনের গবেষণা ফেলো অ্যালেক্স ক্যাপ্রি বলেছেন, ইউক্রেন নিয়ে ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের দিকে যাওয়ার ব্যাপারে বেইজিংকে খুব সতর্ক হতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক সম্পর্ক, তার শক্তির চাহিদা সহ বেইজিংকে ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্নতা এবং প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকির জন্যে পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বেইজিংকে তাড়া করতে পারে। অপরদিকে পশ্চিমা কর্তৃপক্ষও জানে চীনের জন্য ঝুঁকি বেশি। ইউক্রেনে আগ্রাসন ভবিষ্যতে ‘বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি’ তৈরি করবে যা চীনকেও ক্ষতি করতে পারে। এ নিয়ে গত মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বেইজিংকে সতর্কও করেছিলেন।

হিনরিখ ফাউন্ডেশনের ক্যাপ্রির মতানুসারে, চীনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক সম্ভবত রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবকে নিরপেক্ষ করার পরিবর্তে শুধুমাত্র প্রশমিত করবে। এছাড়া কিছু সমস্যা রয়েছে যেখানে চীন সত্যিকার অর্থেই সাহায্য করতে পারবে না।

এদিকে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর ইতিহাস রাশিয়ার পক্ষে নয়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া আক্রমণ এবং সংযুক্ত করার পরে, দেশটি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়ে চীনের সমর্থন চেয়েছিল। যদিও বেইজিং প্রকাশ্যে রাশিয়ার পক্ষে থেকে তাদের শাস্তির বিরোধিতা করেছিল। সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে তাদের প্রচেষ্টা রাশিয়ার সমস্যাগুলি অফসেট করার জন্য যথেষ্ট ছিল না।

কী চাইছে এরদোয়ানের তুরস্ক?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এরদোয়ান মস্কোর ক্ষোভ বাড়িয়েছে। কিয়েভের সঙ্গে দৃঢ় সংহতি প্রদর্শন করেই নয় বরং কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে তুরস্কের উপস্থিতি সম্প্রসারণের জন্য ন্যাটোর বর্তমান কৌশলকে সমর্থন করার মাধ্যমে।

প্রশ্ন উঠেছে ১৯৩৬ মন্টেক্স কনভেনশনের প্রতি আঙ্কারার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিশ্রুতি। কনভেনশনটি তুরস্কের বসফরাস এবং দারদানেলেস প্রণালি যেটি ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণসাগরের মধ্যে সংযোগ করেছে, এর মধ্য দিয়ে সামুদ্রিক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে এবং অ-সাগরীয় রাজ্যগুলির সামরিক জাহাজের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করে কার্যকরভাবে কৃষ্ণসাগরে মার্কিন ও ন্যাটো নৌবাহিনীর প্রবেশাধিকার সীমিত করে।

ন্যাটোর অন্যতম প্রধান সদস্য তুরস্কের মধ্যস্থতায় কিয়েভের কোনো আপত্তি নেই। যদিও জেলেনস্কি ডনবাসে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বিরোধ শেষ করতে পুতিনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তবুও বর্তমান সঙ্কটের প্রতি এরদোয়ানের দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে জেলেনস্কি বলেছেন, ডনবাসের সংঘাত ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতার ভিত্তিতে সমাধান করা উচিত। জেলেনস্কি চাইছেন, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের বিষয়টি তুরস্ক প্রত্যাখান করে একে ‘দখলদারিত্ব’ হিসেবে আখ্যা দিক। যদিও কৌশলী তুরস্ক ইউক্রেনের পাশে থাকার কথা বললেও এমন কিছু করবে না যা তাকে রাশিয়ার কাছে ‘অসম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে তুলে ধরবে।